২৬
যীশুর শেষ দুঃখভোগ ও মৃত্যু।
১ তখন যীশু এই সমস্ত কথা শেষ করলেন এবং তিনি তাঁর শিষ্যদের বললেন, ২ “তোমরা জান, দুই দিন পরে নিস্তারপর্ব্ব আসছে, আর মানবপুত্র ক্রুশে বিদ্ধ হবার জন্য সমর্পিত হবেন।” ৩ তখন প্রধান যাজকেরা ও লোকদের প্রাচীনেরা কায়াফা মহাযাজকের বাড়ির প্রাঙ্গণে একত্র হল, ৪ আর এই ষড়যন্ত্র করল, যেন ছলে যীশুকে ধরে বধ করতে পারে। ৫ কিন্তু তারা বলল, “পর্বের সময় নয়, যদি লোকদের মধ্যে গন্ডগোল বাধে।”
যীশুর অভিষেক।
৬ যীশু তখন বৈথনিয়ায় শিমোনের বাড়িতে ছিলেন, যে একজন কুষ্ঠরোগী ছিল, ৭ তখন একটি মহিলা শ্বেত পাথরের পাত্রে খুব মূল্যবান সুগন্ধি তেল নিয়ে তাঁর কাছে এলো এবং তিনি খেতে বসলে তাঁর মাথায় সেই তেল ঢেলে দিল। ৮ কিন্তু এই সব দেখে শিষ্যেরা বিরক্ত হয়ে বললেন, “এ অপচয়ের কারণ কি? ৯ এই তেল অনেক টাকায় বিক্রি করে তা দরিদ্রদেরকে দেওয়া যেত।” ১০ কিন্তু যীশু, এই সব বুঝতে পেরে তাঁদের বললেন, “এই মহিলাটিকে কেন দুঃখ দিচ্ছ? এ তো আমার জন্য ভালো কাজ করল। ১১ কারণ দরিদ্ররা তোমাদের কাছে সব সময়ই আছে, কিন্তু তোমরা আমাকে সবসময় পাবে না। ১২ তাই আমার দেহের উপরে এই সুগন্ধি তেল ঢেলে দেওয়াতে এ আমার সমাধির উপযোগী কাজ করল। ১৩ আমি তোমাদের সত্যি বলছি, সমস্ত জগতে যে কোন জায়গায় এই সুসমাচার প্রচারিত হবে, সেই জায়গায় এর এই কাজের কথাও একে মনে রাখার জন্য বলা হবে।”
যিহূদা যীশুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সম্মত হলো।
১৪ তখন বারো জনের মধ্যে একজন, যাকে ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা বলা হয়, সে প্রধান যাজকদের কাছে গিয়ে বলল, ১৫ “আমাকে কি দিতে চান, বলুন, আমি তাঁকে আপনাদের হাতে সমর্পণ করব।” তারা তাকে ত্রিশটা রূপার মুদ্রা গুনে দিল। ১৬ আর সেই সময় থেকে সে তাঁকে ধরিয়ে দাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগল।
নিস্তারপর্ব্ব পালন ও প্রভুর ভোজ স্থাপন।
১৭ পরে তাড়ীশূন্য (খামির বিহীন) রুটি র পর্বের প্রথম দিন শিষ্যেরা যীশুর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার জন্য আমরা কোথায় নিস্তারপর্ব্বের ভোজ প্রস্তুত করব? আপনার ইচ্ছা কি?” ১৮ তিনি বললেন, “তোমরা শহরের অমুক ব্যক্তির কাছে যাও, আর তাকে বল, গুরু বলছেন, আমার সময় সন্নিকট, আমি তোমারই বাড়িতে আমার শিষ্যদের সঙ্গে নিস্তারপর্ব্ব পালন করব।” ১৯ তাতে শিষ্যেরা যীশুর আদেশ মতো কাজ করলেন, ও নিস্তারপর্ব্বের ভোজ প্রস্তুত করলেন। ২০ পরে সন্ধ্যা হলে তিনি সেই বারো জন শিষ্যের সঙ্গে খেতে বসলেন। ২১ আর তাঁদের খাওয়ার সময়ে বললেন, “আমি তোমাদের সত্যি বলছি, তোমাদের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।” ২২ তখন তাঁরা অত্যন্ত দুঃখিত হলো এবং প্রত্যেক জন তাঁকে বলতে লাগলেন, “প্রভু, সে কি আমি?” ২৩ তিনি বললেন, “যে আমার সঙ্গে খাবারপাত্রে হাত ডুবাল, সেই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।” ২৪ মানবপুত্রের বিষয়ে যেমন লেখা আছে, তেমনি তিনি যাবেন, কিন্তু ধিক সেই ব্যক্তিকে, যার মাধ্যমে মানবপুত্রকে ধরিয়ে দেওয়া হবে, সেই মানুষের জন্ম না হলেই তার পক্ষে ভাল ছিল। ২৫ তখন যে তাঁকে ধরিয়ে দেবে, সেই যিহূদা বলল, “গুরু, সে কি আমি?” তিনি বললেন, “তুমিই বললে।” ২৬ পরে তাঁরা খাবার খাচ্ছেন, এমন সময়ে যীশু রুটি নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে ভাঙলেন এবং শিষ্যদের দিলেন, আর বললেন, “নাও, খাও, এটা আমার শরীর।” ২৭ পরে তিনি পানপাত্র নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে তাঁদের দিয়ে বললেন, “তোমরা সবাই এর থেকে পান কর, ২৮ কারণ এটা আমার রক্ত, নতুন নিয়মের রক্ত, যা অনেকের জন্য, পাপ ক্ষমার জন্য ঝরবে।” ২৯ আর আমি তোমাদের বলছি, “এখন থেকে সেই দিন পর্যন্ত আমি এই আঙুরের রস পান করব না, যত দিন না আমি আমার পিতার রাজ্যে প্রবেশ করি ও তোমাদের সাথে নতুন আঙুরের রস পান করি।” ৩০ পরে তাঁরা প্রশংসা গান করতে করতে, জৈতুন পর্বতে গেলেন।
পিতরের অস্বীকারের ভবিষ্যবাণী।
৩১ তখন যীশু তাঁদের বললেন, “এই রাতে তোমরা সবাই আমাতে বাধা পাবে (অর্থাৎ তোমরা আমাকে ত্যাগ করবে)”, কারণ লেখা আছে, “আমি মেষ পালককে আঘাত করব, তাতে মেষেরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে।” ৩২ কিন্তু আমি মৃত্যু থেকে জীবিত হবার পরে আমি তোমাদের আগে গালীলে যাব। ৩৩ পিতর তাঁকে বললেন, “যদি সবাই আপনাকে ছেড়েও চলে যায়, আমি কখনও ছাড়বনা।” ৩৪ যীশু তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে সত্যি বলছি, এই রাতে মোরগ ডাকার আগে তুমি তিনবার আমাকে অস্বীকার করবে।” ৩৫ পিতর তাঁকে বললেন, “যদি আপনার সঙ্গে মরতেও হয়, তবু কোন মতেই আপনাকে অস্বীকার করব না।” সেই রকম সব শিষ্যই বললেন।
গেৎশিমানী বাগানে যীশুর মর্ম্মান্তিক দুঃখ।
৩৬ তখন যীশু তাঁদের সঙ্গে গেৎশিমানী নামে এক জায়গায় গেলেন, আর তাঁর শিষ্যদের বললেন, “আমি যতক্ষণ ওখানে গিয়ে প্রার্থনা করি, ততক্ষণ তোমরা এখানে বসে থাক।” ৩৭ পরে তিনি পিতরকে ও সিবদিয়ের দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন, আর দুঃখার্ত্ত ও ব্যাকুল হতে লাগলেন। ৩৮ তখন তিনি তাঁদের বললেন, “আমার প্রাণ মরণ পর্যন্ত দুঃখার্ত্ত হয়েছে, তোমরা এখানে থাক, আমার সঙ্গে জেগে থাক।” ৩৯ পরে তিনি একটু আগে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে প্রার্থনা করে বললেন, “হে আমার পিতা, যদি এটা সম্ভব হয়, তবে এই দুঃখের পানপাত্র আমার কাছে থেকে দূরে যাক, আমার ইচ্ছামত না হোক, কিন্তু তোমার ইচ্ছামত হোক।” ৪০ পরে তিনি সেই শিষ্যদের কাছে গিয়ে দেখলেন, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর তিনি পিতরকে বললেন, “একি? এক ঘন্টাও কি আমার সঙ্গে জেগে থাকতে তোমাদের শক্তি হল না?” ৪১ জেগে থাক ও প্রার্থনা কর, যেন পরীক্ষায় না পড়, আত্মা ইচ্ছুক, কিন্তু শরীর দুর্বল। ৪২ আবার তিনি দ্বিতীয়বার গিয়ে এই প্রার্থনা করলেন, “হে আমার পিতা, আমি পান না করলে যদি এই দুঃখকা পানপাত্র দূরে যেতে না পারে, তবে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক।” ৪৩ পরে তিনি আবার এসে দেখলেন, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন, কারণ তাঁদের চোখ ঘুমে ভারী হয়ে পড়েছিল। ৪৪ আর তিনি আবার তাঁদের ছেড়ে তৃতীয় বার আগের মতো কথা বলে প্রার্থনা করলেন। ৪৫ তখন তিনি শিষ্যদের কাছে এসে বললেন, “এখনও কি তোমরা ঘুমাচ্ছ এবং বিশ্রাম করছ?, দেখ, সময় উপস্থিত, মানবপুত্রকে পাপীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” ৪৬ উঠ, আমরা যাই, এই দেখ, যে ব্যক্তি আমাকে সমর্পণ করবে, সে কাছে এসেছে।
যীশু শত্রুদের হাতে সমর্পিত হন।
৪৭ তিনি যখন কথা বলছিলেন, দেখ, যিহূদা, সেই বারো জনের একজন, এল এবং তার সঙ্গে অনেক লোক, তরোয়াল ও লাঠি নিয়ে প্রধান যাজকদের ও প্রাচীনদের কাছ থেকে এলো। ৪৮ যে তাঁকে সমর্পণ করছিল, সে তাদের এই সংকেত বলেছিল, “আমি যাকে চুমু দেব, তিনিই সেই ব্যক্তি, তোমরা তাকে ধরবে।” ৪৯ সে তখনই যীশুর কাছে গিয়ে বলল, “গুরু, নমস্কার, আর সে তাঁকে চুমু দিল।” ৫০ যীশু তাকে বললেন, “বন্ধু, যা করতে এসেছ, তা কর।” তখন তারা কাছে এসে যীশুর উপরে হস্তক্ষেপ করল ও তাঁকে ধরল। ৫১ আর দেখ, যীশুর সঙ্গীদের মধ্যে এক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে তরোয়াল বার করলেন এবং মহাযাজকের দাসকে আঘাত করে তার একটা কান কেটে ফেললেন। ৫২ তখন যীশু তাঁকে বললেন, “তোমার তরোয়াল যেখানে ছিল সেখানে রাখ, কারণ যারা তরোয়াল ব্যবহার করে, তারা তরোয়াল দিয়েই ধ্বংস হবে।” ৫৩ আর তুমি কি মনে কর যে, যদি আমি আমার পিতার কাছে অনুরোধ করি তবে তিনি কি এখনই আমার জন্য বারোটা বাহিনীর থেকেও বেশি দূত পাঠিয়ে দেবেন না? ৫৪ কিন্তু তা করলে কেমন করে শাস্ত্রের এই বাণীগুলি পূর্ণ হবে যে, এমন অবশ্যই হবে? ৫৫ সেই সময়ে যীশু লোকদেরকে বললেন, “লোকে যেমন দস্যু ধরতে যায়, তেমনি কি তোমরা তরোয়াল ও লাঠি নিয়ে আমাকে ধরতে এসেছো? আমি প্রতিদিন ঈশ্বরের মন্দিরে বসে উপদেশ দিয়েছি, তখন তো আমাকে ধরলে না।” ৫৬ কিন্তু এ সমস্ত ঘটল, যেন ভাববাদীদের লেখা ভাববাণীগুলি পূর্ণ হয়। তখন শিষ্যেরা সবাই তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।
মহাযাজকের সামনে যীশুর বিচার।
৫৭ আর যারা যীশুকে ধরেছিল, তারা তাঁকে মহাযাজক কায়াফার কাছে নিয়ে গেল, সেই জায়গায় ব্যবস্থার শিক্ষকেরা ও প্রাচীনেরা সমবেত হয়েছিল। ৫৮ আর পিতর দূরে থেকে তাঁর পিছনে পিছনে মহাযাজকের প্রাঙ্গণ পর্যন্ত গেলেন এবং শেষে কি হয়, তা দেখার জন্য ভিতরে গিয়ে পাহারাদারদের সঙ্গে বসলেন। ৫৯ তখন প্রধান যাজকরা এবং সমস্ত মহাসভা যীশুকে বধ করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রমাণ খুঁজতে লাগল, ৬০ কিন্তু অনেক মিথ্যাসাক্ষী এসে যুটলেও, তারা কিছুই পেল না। ৬১ অবশেষে দুই জন এসে বলল, “এই ব্যক্তি বলেছিল, আমি ঈশ্বরের মন্দির ভেঙে, তা আবার তিন দিনের মধ্যে গেঁথে তুলতে পারি।” ৬২ তখন মহাযাজক উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে বললেন, “তুমি কি কিছুই উত্তর দেবে না? তোমার বিরুদ্ধে এরা কিসব বলছে?” ৬৩ কিন্তু যীশু চুপ করে থাকলেন। মহাযাজক তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে জীবন্ত ঈশ্বরের নামে দিব্যি করছি, আমাদেরকে বল দেখি, তুমি কি সেই খ্রীষ্ট, ঈশ্বরের পুত্র?' ৬৪ যীশু এর উত্তরে বললেন, “তুমি নিজেই বললে, আর আমি তোমাদের বলছি, এখন থেকে তোমরা মানবপুত্রকে পরাক্রমের (সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের) ডান পাশে বসে থাকতে এবং আকাশের মেঘরথে আসতে দেখবে।” ৬৫ তখন মহাযাজক তাঁর বস্ত্র ছিঁড়ে বললেন, “এ ঈশ্বরনিন্দা করল, আর প্রমাণে আমাদের কি প্রয়োজন? দেখ, এখন তোমরা ঈশ্বরনিন্দা শুনলে, ৬৬ তোমরা কি মনে কর?” তারা বলল, “এ মৃত্যুর যোগ্য।” ৬৭ তখন তারা তাঁর মুখে থুথু দিল ও তাঁকে ঘুষি মারল, ৬৮ আর কেউ কেউ তাঁকে আঘাত করে বলল, “রে খ্রীষ্ট, আমাদের কাছে ভাববাণী বল, কে তোকে মারল?”
পিতর যীশুকে তিনবার অস্বীকার করেন।
৬৯ এদিকে পিতর যখন বাইরে উঠোনে বসেছিলেন, তখন আর একজন দাসী তাঁর কাছে এসে বলল, “তুমিও সেই গালীলীয় যীশুর সঙ্গে ছিলে।” ৭০ কিন্তু তিনি সবার সামনে অস্বীকার করে বললেন, “তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।” ৭১ তিনি দরজার কাছে গেলে আর এক দাসী তাঁকে দেখতে পেয়ে লোকদেরকে বলল, “এ ব্যক্তি সেই নাসরতীয় যীশুর সঙ্গে ছিল।” ৭২ তিনি আবার অস্বীকার করলেন, দিব্যি করে বললেন, “আমি সে ব্যক্তিকে চিনি না।” ৭৩ আরও কিছুক্ষণ পরে, যারা কাছে দাঁড়িয়েছিল, তারা এসে পিতরকে বলল, “সত্যিই তুমিও তাদের একজন, কারণ তোমার ভাষাই তোমার পরিচয় দিচ্ছে।” ৭৪ তখন তিনি অভিশাপের সঙ্গে শপথ করে বলতে লাগলেন, “আমি সেই ব্যক্তিকে চিনি না।” তখনই মোরগ ডেকে উঠল। ৭৫ তাতে যীশু এই যে কথা বলেছিলেন, ‘মোরগ ডাকার আগে তুমি তিনবার আমাকে অস্বীকার করবে,’ তা পিতরের মনে পড়ল এবং তিনি বাইরে গিয়ে অত্যন্ত করুন ভাবে কাঁদলেন।